দুর্নীতির ধারণা
ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক অবৈধ পন্থায় নীতি-বহির্ভূত বা জনস্বার্থবিরোধী কাজই দুর্নীতি। রাজনৈতিক এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রশাসনে দুর্নীতি বলতে ব্যক্তিগত স্বার্থ বা লাভের জন্য কার্যালয়ের দায়িত্বের অপব্যবহারকে বুঝায়। সাধারণত ঘুষ,স্বজনপ্রীতি, কলপ্রয়োগ বা ভয় প্রদর্শন, প্রভাব খাটানো এবং ব্যক্তি বিশেষকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে প্রশাসনের ক্ষমতা অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থ অর্জনকে দুর্নীতি বলে। অবৈধ সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য কোনো ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃত অবহেলাও দুর্নীতি। দুর্নীতির সাথে যুক্ত থাকে পেশা, ক্ষমতা, পদবি, স্বার্থ, নগদ অর্থ, বস্তুসামগ্রী প্রভৃতি। দুর্নীতির মাধ্যমে কাউকে না কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। এ অপরাধের প্রকৃতি ও কলাকৌশল আলাদা । এ কাজে দৈহিক শ্রমের চেয়ে ধূর্ত বুদ্ধির প্রয়োজন বেশি।
দুর্নীতির কারণ
বাংলাদেশে দুর্নীতির কারণ বহুবিধ। মূলত লোভ ও উচ্চাভিলাষী মনোভাব ব্যক্তিকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে। অনেক চাকরিজীবী দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অতিরিক্ত আয়ের চেষ্টা করে। তারা ফাইলের কাজের বিনিময়ে ঘুষ, বকশিশ, কমিশন, চা-নাস্তা বাবদ খরচ, দ্রব্যসামগ্রী প্রভৃতি আদায় করে থাকে। কখনো এসব দুর্নীতিবাজরা দাপ্তরিক ফাইল আটকিয়ে ঘুষ গ্রহণ করে। আবার অনেক সময় অফিসের প্রধান কর্তার টেবিলে দীর্ঘদিন নানা কারণে ফাইলবন্দি হওয়ার কারণে অধস্তন কর্মচারী এ সুযোগ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে ফাইলবন্দি করাও দুর্নীতি। অফিসের প্রধান বা শাখাপ্রধান দুর্নীতিবাজ হলে এর প্রভাব সংশ্লিষ্ট সকল শাখায় সংক্রমিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে কর্মকর্তা এবং কর্মচারীকে বিলাসী জীবন বা উচ্চাকাঙ্ক্ষার নেশা ও স্বল্পসময়ে অধিক সম্পদের মালিক হওয়ার প্রত্যাশা দুর্নীতিবাজে পরিণত করে। এদের বৈধ উপার্জনের সাথে জীবনযাত্রার মানের মিল থাকে না। এসব পরিবারের সদস্যদের চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধে দুর্নীতি মিশে থাকে। পরবর্তী জীবনে এরাও দুর্নীতিবাজে পরিণত হয়। এদের অনেকের চাকরি জীবন শুরু হয় অন্য এক দুর্নীতিবাজের মাধ্যমে। পরিবারের সদস্যদের অধিক চাহিদাও অনেক সময় উপার্জনকারীকে দুর্নীতি করতে বাধ্য করে।
বর্তমান সরকার শিক্ষিত বেকারদের জন্য নানাবিধ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। প্রথম শ্রেণির চাকুরি থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির চাকুরিসহ সমস্ত সরকারি চাকুরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করেছেন।
কাজ-একক : একটি অফিস বেছে নাও এবং উক্ত অফিসে কতভাবে দুর্নীতি হতে পারে তার একটি চিত্র তুলে ধর। একক : দুর্নীতি প্রতিরোধে গড়ে ওঠা একটি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত কর এবং এ প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য দুর্নীতির চিত্র তুলে ধর। দলগত: পারিবারিক জীবনে দুর্নীতির প্রভাব চিহ্নিত কর এবং প্রতিরোধ পদক্ষেপ লেখ । |
রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার অভাব, অগণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা দুর্নীতি বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। রাজনীতিতে দেশপ্রেমিক, যোগ্য এবং দক্ষ নেতৃত্বের অভাবও দুর্নীতির অনুকূল পরিবেশের সহায়ক। দুর্নীতিবাজদের কোনো মানবিকতা এবং দেশপ্রেম থাকে না। অনেক সময় দেখা যায় দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব সমাজ জীবনকে অস্থির করে তোলে। এ সামাজিক অস্থিরতাই আবার দুর্নীতির জন্ম দিয়ে থাকে। ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতাও অনেক ক্ষেত্রে সমাজে দুর্নীতি বাড়িয়ে তোলে। দুর্নীতিবাজ, নকলবাজ, ভেজাল মিশ্রণকারী ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা অর্জনের আশায় ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় নেমে দুর্নীতি করে।
সাধারণত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে অনেক সময় ব্যবসায়ী, আড়তদার, মওজুদদার, মুনাফাখোর, মধ্যস্বত্বভোগী, ফটকা কারবারীরা দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলে। তারা প্রতারণা ও দুর্নীতির মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জন করে। এর ফলে স্বল্প আয়ের লোকেরা অর্থকষ্টের কারণে বাঁচার তাগিদে দুর্নীতির আশ্রয়গ্রহণ করে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান যখন দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যর্থ হয় কিংবা এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে তখন সমাজ ব্যাপকভাবে দুর্নীতিতে ছেয়ে যায়। ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ও সমাজে দুর্নীতি বাড়িয়ে তুলতে পারে ।
দুর্নীতির প্রভাব ও প্রতিরোধ
সমাজ জীবনে দুর্নীতির ক্ষতিকর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যে সমাজ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে সে সমাজে একে অন্যের দ্বারা প্রতারিত হয়। দুর্নীতিবাজও অন্যের দুর্নীতির শিকারে পরিণত হয়। ন্যায্য অধিকারের বঞ্চনা দুর্নীতিপ্রবণ সমাজের চিত্র। চাকরিজীবনে স্বজনপ্রীতি বা ঘুষের বিনিময়ে যদি অযোগ্যরা নিয়োগ এবং পদোন্নতি পায় তাহলে সমাজের যোগ্যরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। দুর্নীতির কারণে সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়। মানুষের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করে, ফলে যোগ্যদের প্রতিভা বিকশিত হয় না । সৃজনশীলতা ক্রমশ হ্রাস পায়। দুর্নীতিপ্রবণ সমাজে আইন-শৃঙ্খলা, নিয়ম-কানুন প্রভৃতির প্রতি মানুষ শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। দুর্নীতি অফিসের কর্মকর্তা, কর্মচারীর মধ্যে দায়িত্ব-কর্তব্যে অনীহা এবং সম্পদের অপব্যবহার করার মানসিকতা সৃষ্টি করে। দুর্নীতির কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যায়। সততা, আদর্শ এবং মূল্যবোধ লোপ পেতে থাকে। সামগ্রিকভাবে দুর্নীতি জাতীয় বিপর্যয়ের মূল কারণ। এটি দেশের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির প্রতিবন্ধক।
দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজন ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি ও সামাজিক আন্দোলন। গণসচেতনতা গড়ে তোলার কার্যকর হাতিয়ার হলো গণমাধ্যম। গণমাধ্যমে দুর্নীতি সম্পর্কে তথ্য প্রচার করে গণসচেতনতা গড়ে তোলা সম্ভব। সমাজের সর্বস্তরে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা হলে দুর্নীতি নির্মূল করা যায়। উপার্জন, ব্যয়, সম্পদের হিসাব প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমেও অনেক দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খোলা সম্ভব। দুর্নীতিবাজ, নকলবাজ, প্রতারক ও মুখোশধারীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনলে দুর্নীতি উচ্ছেদ সহজতর হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচি প্রভৃতির মাধ্যমেও দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব। তাছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটলে সমাজ থেকে দুর্নীতির অবসান ঘটবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে বর্তমান সরকার নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালীকরণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর 'জিরো টলারেন্স' ঘোষণা দুর্নীতি প্রতিরোধে বর্তমান সরকারের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
Read more